সময় তার নিজস্ব গতিতে চলে, আর ইতিহাসও কখনো কখনো আচমকা মোচড় নিয়ে নতুন রূপ নেয়—কিন্তু এই মোচড় কি সবার কাছে পৌঁছায়? রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল, রাষ্ট্রীয় ভাষ্য বদলানোর প্রক্রিয়া সব জায়গায় সমানভাবে গ্লোরি পায় না। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দফা ঘুরে যায়—শেখ হাসিনার শাসনকাল শেষে নতুন নেতৃত্বের সূর্যোদয় হয়। কিন্তু, এই পরিবর্তন শুধু সরকারি দপ্তরগুলো, নীতিনির্ধারকদের চাহিদা ও ভবিষ্যৎকে অবলম্বন করল, নাকি প্রশাসনিক কাঠামোতে শিকড় গেড়ে থাকা কিছু পুরোনো অবস্থা এখনও পরিবর্তনের শিকড় স্পর্শ করেনি?
এই প্রশ্নের উত্তর এসেছে ৮ মে, ২০২৪ সালে—যেদিন আমি লক্ষ্য করি, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বালিয়াডাঙী ফায়ার সার্ভিস স্টেশন তার ওয়েবসাইটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিকৃতি এখনও প্রদর্শন করে চলেছে। এটা শুধু পুরোনো প্রতিকৃতি নয়—এটা রাষ্ট্রের পরিবর্তনকে অবজ্ঞা করার একটি ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত। ১০ মাস পরেও এই ফায়ার সার্ভিস স্টেশন সচেতন হয়নি, পরিবর্তন যে এসেছে, তার প্রমাণও তারা অস্বীকার করেছে। কিন্তু, কেন? কেন এখনো সেখানে পুরোনো রাজনীতি ও মুখাবয়ব আঁকড়ে থাকলো?
তবে, এক নাগরিকের সামান্য প্রতিবাদে এক ঘণ্টার মধ্যে ছবিগুলো সরিয়ে ফেলা হলো। কি আশ্চর্য! দশ মাসের অনুকম্পা এক ঘণ্টার সচেতনতায় কীভাবে ভেঙে পড়ল? প্রশ্ন কিন্তু এখানেই—এটা কি কাকতাল, নাকি প্রশাসনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ঢাকার এক অপ্রত্যাশিত চাল?
এটা যদি কাকতাল হতো, তবে ১০ মাস ধরে যে অনাগ্রহ এবং নির্লিপ্ততা ছিল, তা এক ঘণ্টায় কেন বদলালো? এটা ছিল প্রশাসনের অবহেলার ভীষণ ভয়—আর সেই ভয়কে প্রভাবিত করতে গিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল এক প্রতিকৃতি, যা সম্ভব হয়েছিল একটি দায়বদ্ধ নাগরিকের একটিমাত্র ফেসবুক পোস্টে। এখানে একটি অন্ধকার পরিসরের বাস্তবতা সামনে আসে—আমরা এমন এক রাষ্ট্রে বসবাস করছি যেখানে ব্যবস্থাপনা আছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনায় কাজ করার চেতনা নেই; যেখানে কর্তৃপক্ষ আছে, কিন্তু তাদের দায়িত্ববোধের কোনও অস্তিত্ব নেই।
এখানে সমস্যা শুধু একটি অফিসের নয়, এটি গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অসুস্থতার লক্ষণ। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে এ ধরনের অবহেলা রীতিমতো রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার ঘাটতি এবং দায়বদ্ধতার অভাবের প্রকাশ। কেবল একটি ওয়েবসাইটের ছবির পরিবর্তন নয়—এটা আমাদের প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি মর্মান্তিক বিচ্যুতি।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা আমাকে ফোনে বলেছিলেন, “ছবিগুলো সরানো হবে আগামী সপ্তাহে।” এতটা অবহেলা, এতটা দীর্ঘসূত্রিতা—কী করে সম্ভব? যেখানে বিশ্বব্যাপী তথ্য এক সেকেন্ডে আপডেট হয়, সেখানে একটি ছবির জন্য সপ্তাহের অপেক্ষা। এটিই কি আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের চিত্র?
রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলো যেন কেবল কাগজপত্র চালানোর অটোমেটেড যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সময় বদলে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা কি সেই বদলানো সময়ে নিজেদের সঙ্গ দিতে পারছি? আধুনিক রাষ্ট্রের সচেতনতা শুধু রাজধানী কিংবা সরকারি অফিস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না; সেটা ইউনিয়ন, মফস্বল, এমনকি প্রতিটি ছোট অফিসে ছড়িয়ে পড়তে হবে।
এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই অবহেলা পুরো দেশকে প্রভাবিত করে—এটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের অভাব, আমাদের প্রশাসনিক সিস্টেমের ব্যর্থতার এক বাস্তব চিত্র। যদি আমি, এম এইচ মুন্না, এক নাগরিক হিসেবে একটি ছোট পোস্ট দিয়েই প্রশাসনকে সজাগ করে তুলতে পারি, তবে বুঝে নিতে হবে যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতরে কোনো পরিবর্তন আনতে প্রচেষ্টা ও সজাগ নাগরিক কণ্ঠই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।
বালিয়াডাঙী ফায়ার সার্ভিসের এই ঘটনার মাধ্যমে, পুরো দেশের প্রশাসনিক অচেতনতার সংস্কৃতি যেন উন্মোচিত হয়। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো কতটা ধীরগতিতে চলে, কতটা দায়িত্বহীন এবং কতটা দীন-দরিদ্র হতে পারে—এটা আজ প্রমাণিত। এটাই তো সেই 'অনুর্বরতা', যাকে সমাজ কখনো অনুধাবন করতেই চায় না। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রে আরও সচেতনতার, আরও দায়িত্ববোধের প্রয়োজন, যেন আর কোন ফায়ার সার্ভিস সিস্টেম ইতিহাসের বাহিরে পড়ে না থাকে।
লেখক: এম.এইচ. মুন্না
প্রধান সম্পাদক | দৈনিক গণতদন্ত