1. info@dainikgonatadanta.com : দৈনিক গণতদন্ত :
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ০৭:২১ পূর্বাহ্ন
বিজ্ঞাপন:
জরুরী নিয়োগ চলছে, দেশের প্রতিটি বিভাগীয় প্রতিনিধি, জেলা,উপজেলা, স্টাফ রিপোর্টার, বিশেষ প্রতিনিধি, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি, ক্যাম্পাস ও বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি বা সাংবাদিক নিয়োগ চলছে।

চিরকুটে গুলি: আত্মহননের আগুনে জ্বলতে থাকা রাষ্ট্রযন্ত্রের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি

রিপোর্টারের নাম :
  • প্রকাশিত: বুধবার, ৭ মে, ২০২৫
  • ৪০ বার পড়া হয়েছে

 

 

নিজ কার্যালয়ে, রাষ্ট্রীয় দাপ্তরিক অস্ত্র দিয়ে, নিজ মস্তিষ্ক উড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন এক তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল পুলিশ কর্মকর্তা—সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পলাশ সাহা। মৃত্যুস্থল কোনো অপরাধীর লুকিয়ে থাকা গোপন আস্তানা নয়; বরং সেটি ছিল তার নিজস্ব কর্মস্থল, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতীক। সেখানে, শান্তি প্রতিষ্ঠার অস্ত্রই পরিণত হলো আত্মবিনাশের নির্মম হাতিয়ারে। ছোট্ট একটি চিরকুট রেখে গেছেন, যার প্রতিটি শব্দ যেন ধ্বনিত করে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিস্পৃহতা ও সমাজের যান্ত্রিক নিঃশব্দতা।

চিরকুটে পলাশ সাহা লিখে গেছেন:
“আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমি নিজেই দায়ী।”

কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই দায় শুধু তার একার? রাষ্ট্র কি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে এই বাক্যের আড়ালে লুকিয়ে? পরিবার কি দায়মুক্ত হবে “ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত” বলেই? সমাজ কি আবারও RIP-এর আশ্রয়ে তার কণ্ঠরোধ করা কান্না ভুলে যাবে?

এই মৃত্যু নিছক একটি আত্মহত্যা নয়। এটি রাষ্ট্রীয় বিমূর্ত অক্ষমতা, পারিবারিক সংঘাতের স্থায়ী ক্ষত এবং পুরুষতান্ত্রিক অনুভূতিহীনতার এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি। একদিকে মা, অন্যদিকে স্ত্রী—এই দ্বৈত সম্পর্কের উত্তাপে বিদ্ধ পলাশ, সমাজের চোখে “দুর্বল”, “অক্ষম”, আর হয়তোবা “অযোগ্য” হয়ে উঠেছিলেন। অথচ তিনিই দিনের পর দিন দেশপ্রেমের আদর্শ তুলে ধরে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়েছেন অপরাধীদের বিপরীতে। কিন্তু যখন নিজের বাড়ি হয়ে ওঠে মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র, তখন সেই অস্ত্র তারই কপালে স্থাপন করে জীবনের ইতি টেনে দেয়।

সমাজের প্রচলিত বুলি—“পরিবার মানেই আশ্রয়”—আজ আর বাস্তবতাকে ধারণ করতে ব্যর্থ। পরিবার এখন অনেকক্ষেত্রে হয়ে উঠছে এক অনুপযুক্ত যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে একজন পুরুষের চোখের জলই হয়ে পড়ে অবজ্ঞার উপাদান। স্ত্রী-মা দ্বন্দ্ব কেবল টেলিভিশনের নাট্যপ্রতিক্রিয়া নয়—এটি আজ বাস্তবতার এক হিংস্র রূপ। রাষ্ট্র ও সমাজ এই মানসিক সংহতির অভাবে একজন কর্মকর্তার জীবনীশক্তিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।

আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি—পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক এবং পারিবারিক চাপে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছেন। তারা যেন জীবন্ত যন্ত্র, যাদের অনুভূতি, আবেগ, ক্লান্তি—সবই অপ্রাসঙ্গিক। কর্তব্যপরায়ণতার মুখোশের আড়ালে তারা হয়ে উঠেছেন ভেতরে ভেতরে জ্বলে-পুড়ে শেষ হতে থাকা মানুষ।

আত্মহত্যাকে এখনো দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন বললে আমরা বলি—“শক্ত থাকো”, “চিন্তা করো না”, “কাজে ডুবে যাও”, “পুরুষ হয়ে এতো আবেগ কেন?” কিন্তু ঠিক সেই চেপে রাখা আবেগই যখন বিস্ফোরণে রূপ নেয়, তখন আমরা শুধু চমকে উঠি—তারপর নিঃশব্দে ভুলে যাই।

প্রশ্ন উঠেছে—এটাই কি প্রথম? কই, প্রশাসন কি কখনো আত্মসমালোচনার দর্পণে মুখ দেখেছে? পুলিশের আত্মহননের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু প্রতিরোধ কোথায়? মানসিক চাপের দায় কেবল ব্যক্তি কেন বহন করবে?

এই মৃত্যুর দায় শুধু পলাশ সাহার নয়—এটি রাষ্ট্রের, সমাজের, পরিবারব্যবস্থার এবং আমাদের সবার সম্মিলিত ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত দলিল। এর প্রতিকার প্রয়োজন কঠিন নীতিগত সংস্কার ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে। প্রয়োজন পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জন্য বাধ্যতামূলক মনোবৈজ্ঞানিক পরামর্শ সেবা। প্রয়োজন সংসার নামক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় সহনশীলতার চর্চা। সবচেয়ে বেশি দরকার—পুরুষও যে ভেঙে পড়ে, কাঁদে, সমর্থন চায়—তা সমাজকে উপলব্ধি করানো।

পলাশ সাহা নেই। রেখে গেছেন ব্যর্থতার একটি ব্যঞ্জনাময় প্রতিচ্ছবি। তার স্ত্রী হয়তো নিজেকে নির্দোষ দাবি করবেন, মা হয়তো বাকরুদ্ধ থাকবেন। কিন্তু আমরা? আমরা যারা এই রাষ্ট্রযন্ত্রের দর্শক, যারা RIP লিখে দায় শেষ করি—আমরাই কি প্রকৃত অপরাধী নই?

🖊️লেখক: এম এইচ মুন্না
প্রধান সম্পাদক, দৈনিক গণতদন্ত

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো সংবাদ পড়ুন
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট