
আজমেরি (৪–ছদ্মনাম) রাজধানীর পান্থপথের একটি স্কুলে প্লে গ্রুপে পড়ে। সপ্তাহখানেক আগে স্কুল থেকে ফেরার পরপরই ওর হাতে কিছু ফোসকার মতো দেখতে পান মা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এসব গুঁড়ি গুঁড়ি ফোসকা। হাত থেকে পায়ে, হাঁটুতে ছড়িয়ে পড়ে এক দিনের মধ্যেই। এরপর সঙ্গে ছিল হালকা জ্বর।
আজমেরির মা–বাবা দুজনেরই ধারণা ছিল, ছেলের চিকেন পক্স হয়েছে। তাঁরা পরদিনই ওকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক জানান, এটি পক্স নয়। এর নাম ‘হ্যান্ড–ফুট–মাউথ’। এ অসুখ ভাইরাসবাহিত।
চিকিৎসক আজমেরির মা–বাবাকে আশ্বস্ত করেন, এটি একেবারে জটিল কোনো অসুখ নয়। তবে প্রচণ্ড ছোঁয়াচে। পরিবারের একাধিক শিশু থাকলে তার থেকে শিশুকে আলাদা রাখার জন্যও পরামর্শ দেন তিনি। শিশুটির জ্বর দুই দিনের বেশি থাকেনি। তবে এসব ফোসকা কমতে ছয় দিন পর্যন্ত সময় লেগেছে।

শিশুটির বাবা বলেন, ‘গলার ভেতরেও এসব গুঁড়ি ওঠে। ছেলেটা খেতে পারত না। চিকিৎসকের পরামর্শমতো আমরা তরল খাবার বেশি খাইয়েছি। সাত দিনের মতো এ সমস্যা থেকেছে।’
চিকিৎসকের পরামর্শমতো আজমেরিকে ফোসকাগুলো না শুকানো পর্যন্ত স্কুলে যেতে দেননি মা–বাবা। এভাবে রাজধানীর নানা প্রান্তের শিশুরা ‘হ্যান্ড–ফুট–মাউথ’ অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। সাধারণত প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।
রাজধানীর চারটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে রোগটির বিস্তারের কথা জানা গেছে। একটি ইংরেজি মাধ্যম শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন এ রোগের বাড়তে থাকা প্রবণতার কথা জানিয়েছেন।
দেশের খ্যাতনামা শিশুবিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সহিদুল্লা গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘আমি প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি শিশুকে পাচ্ছি, যারা হ্যান্ড–ফুট–মাউথে আক্রান্ত। গত দুই তিন বছরে এর তেমন প্রাদুর্ভাব দেখিনি। এবার এর বিস্তার তুলনামূলকভাবে বেশি হয়েছে।’
হ্যান্ড–ফুট–মাউথ রোগের লক্ষ্মণ কী, কাদের হয়
চিকিৎসকেরা বলছেন, সাধারণত এক বা দেড় বছর বয়স থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের এ রোগ হয়। তবে তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের এ রোগ বেশি হয়।
কক্সস্যাকিভাইরাস নামে একটি ভাইরাসের প্রভাবে এ অসুখ হয়। প্রাথমিকভাবে জ্বর হয়। আবার অনেকের জ্বর নাও হতে পারে। আবার কারও জ্বার বাড়তেও পারে। এরপর হাতে, পায়ের পাতায়, কনুই ও হাঁটুতে ফুসকুড়ি হয়। অনেক শিশুর মুখের ভেতরেও ফুসকুড়ি হয়। এগুলো দেখতে চিকেন পক্সের মতো অনেকটা। দেখলে মনে হয়, এসব ফুসকুড়ির মধ্যে ঘোলা পানি জমেছে।
জ্যেষ্ঠ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘মুখ গহ্বরে হলেই শিশুদের বেশি কষ্ট হয়। এ সময়টাতে শিশুদের খেতে অসুবিধা হয়। খাবার গিলতে ব্যথা লাগে।’
কোন সময় এ রোগ বেশি হয়, সুরক্ষার উপায় কী
সাধারণত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এ রোগ হয়। বর্ষা মৌসুমেই এর প্রকোপ বাড়ে বলে জানান চিকিৎসকেরা। পাঁচ বছর আগে এর বেশি বিস্তার ঘটেছিল বলে স্মরণ করতে পারেন অধ্যাপক সহিদুল্লা। এরপর এ বছর বেশি হার ঘটছে, বিশেষ করে রাজধানীতে। তবে দেশের অন্য স্থানেও এটি ছড়ানোর আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন তিনি।
চিকিৎসকেরা বলছেন, হ্যান্ড–ফুট–মাউথ ছোঁয়াচে অসুখ। কোনো শিশু এতে আক্রান্ত হলে তাকে অবশ্যই স্কুলে দেওয়া যাবে না। পরিবারের মধ্যেও একধরনের আইসোলেশনে তাকে রাখতে হবে।
শিশুবিশেষজ্ঞ আবিদ হোসেন মোল্লা বলছিলেন, এই ছোঁয়াচে রোগ সাধারণত হাঁচি–কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। এ ছাড়া শরীরে হওয়া ফুসকুড়িগুলোর ফেটে গেলে সেখানকার রস থেকে ছড়াতে পারে। বাড়ির অন্য শিশুরা যাতে আক্রান্ত না হতে পারে, সে জন্য অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে।
শিশুর চিকিৎসা কী হবে
চিকিৎসকেরা বলছেন, ভাইরাসবাহিত এ অসুখের কোনো টিকা নেই। আসলে এর কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধও নেই। অধ্যাপক সহিদুল্লা বলেন, হ্যান্ড–ফুট–মাউথে আক্রান্তদের জ্বর হলে সাধারণ জ্বরের ওষুধ দিতে হবে। আর অ্যান্টিহিস্টামিন দিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
সাধারণত অসুখবিসুখ হলে শিশুরা কম খাবার–দাবার গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রেও খাবারের জন্য জোর–জবরদস্তির কোনো দরকার নেই বলেই মনে করেন আবিদ হোসেন মোল্লা। তাঁর কথা, শিশু কিছু কম খেলে ক্ষতি নেই। কিন্তু তাকে যথেষ্ট পানি খাওয়াতে হবে। একটু বড় শিশুকে দুধ বা আইসক্রিম দেওয়া যেতে পারে। মুখের ভেতরে ফুসকুড়ি ওঠায় কম খেতেই পারে। কিন্তু বারবার পানি খাওয়াতে হবে। একটি বিষয় সতর্কভাবে দেখতে হবে, শিশুর প্রস্রাব যেন স্বাভাবিক হয়।
ভিটামিন সি বেশি করে গ্রহণ করলে এ অসুখ দ্রুত সারে এর কোনো প্রমাণও নেই বলে জানান ডা. আবিদ। তিনি এ অসুখ হলে শিশুকে নিয়মিত গোসল করানোর পরামর্শ দেন। তাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ধুতে হবে। আর আবিদের পরামর্শ হলো, করোনাভাইরাসের জন্য যেসব নিয়ম মেনে চলা হয়, এ ক্ষেত্রেও তার অনেকটা করতে হবে। সাবান দিয়ে ক্ষতস্থানগুলোও পরিষ্কার করা যেতে পারে।
ভীতির একেবারেই কোনো কারণ নেই
চিকিৎসকেরা বলছেন, হ্যান্ড–ফুট–মাউথ নিয়ে ভীতির