রাষ্ট্রের নামধারী উন্নয়ন প্রকল্পের নামে যখন পুষ্যি প্রজাতন্ত্রের সুশ্রী পৃষ্ঠপোষকেরা গলাধঃকরণে মত্ত হয়, তখন একে আমরা কী বলব? দুর্নীতি, নাকি শৃঙ্খলিত অপশাসনের সূক্ষ্ম কারিগরি? “বাংলাদেশ সাসটেইনেবল রিকভারি ইমারজেন্সি অ্যান্ড রেসপন্স” (বি-স্ট্রং) প্রকল্পে যেভাবে যন্ত্রাংশ কেনাকাটার নামে পয়সার পাহাড় বানানোর নীলনকশা তৈরি হয়েছে, তা কেবল আর্থিক অনিয়ম নয়—এ এক রাষ্ট্রীয় চেতনার অবক্ষয়, যেখানে প্রজাতন্ত্রের দায়বদ্ধতা নয়, লুটের মেধাই প্রধান চালিকাশক্তি।
বিশ্ব ব্যাংকের ১,৬৪৭ কোটি টাকার অর্থায়নে এবং সরকারের সংযুক্ত ২৬২ কোটি টাকায় গঠিত প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল ২০২৪ সালের বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন। কিন্তু প্রকল্পের কাজ মাঠে নামার আগেই পরিকল্পনার খাতায় ‘লুটপাটের ল্যাপটপ’ আর ‘মুনাফার মোটরসাইকেল’ ঢুকে যাওয়াটা আমাদের লজ্জিত করে তোলে না, বরং স্পষ্ট করে তোলে—ব্যবস্থাপনার শিকড়ে পচন কতোটা গভীরে গিয়েছে।
৭২ হাজার টাকায় স্ট্রিট সোলার লাইট কেনার প্রস্তাব, যেখানে পরিকল্পনা কমিশনের স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ—এসব লাইটের প্রয়োজনই নেই। তাহলে কি এই মূল্যায়ন একপ্রকার পরিকল্পিত ‘প্রকল্পীয় মিথ্যাচার’? ৪টি ল্যাপটপের জন্য ১১ লাখ টাকা ব্যয়—যেখানে প্রতিটির বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ৪০-৫০ হাজার টাকা—এই ব্যয়ের পর্দার আড়ালে রয়েছে অদৃশ্য কমিশন বণ্টনের ছক?
প্রস্তাবিত ৬০টি মোটরসাইকেলকে পরিকল্পনা কমিশন ৩৬টিতে নামিয়ে আনলেও, প্রশ্ন থেকে যায়—উৎসাহীরা কেন এতটা আগ্রহী ছিলেন এই চক্রবাহু যানবাহনে? এটি কি শুধুই বাহন, নাকি ঘূর্ণায়মান কমিশনের প্রতীক?
এখানে দুর্নীতির বিষয়টি কেবল সংখ্যার খেলা নয়। এটি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, যেখানে প্রকল্প পরিকল্পনাকে ঘিরে গড়ে তোলা হয় সুবিধাভোগী আমলাতান্ত্রিক সিন্ডিকেট। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই সিন্ডিকেটের দরজায় কড়া নাড়লেও, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—নথিপত্র গায়েব, তদন্ত দীর্ঘসূত্রতা এবং অভিযুক্তদের ‘সক্ষমতার ঢাল’ দিয়ে পুষে তোলা হয় দায়মুক্তির সংস্কৃতি।
এই সংস্কৃতি কেবল প্রকল্পকে কলঙ্কিত করে না, বরং পুরো উন্নয়ন দর্শনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। যখন বৈদেশিক অর্থায়নের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রকল্প শুরু হবার আগেই বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসে, তখন বিশ্ব ব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে বাংলাদেশ কেমন বার্তা দিচ্ছে?
এই মুহূর্তে আমরা কেবল তথ্য-সংগ্রহ আর প্রতিবেদন প্রদানের ঘূর্ণিপাকে ঘুরে দাঁড়াতে পারি না। আমাদের দরকার প্রতিটি প্রকল্পে অডিট-প্রকল্পায়ন-জনদায়িত্বের সমান্তরাল সমন্বয়, যেখানে জনগণ কেবল উন্নয়নের ভোক্তা নয়, তদারকির অংশীদার।
‘বি-স্ট্রং’ প্রকল্প যদি সত্যিই টিকে থাকতে চায়, তবে তাকে দুর্নীতির বালুমহাল থেকে বেরিয়ে জনগণের আস্থার খালপথে ফিরে আসতে হবে। নয়তো এই প্রকল্পও রাষ্ট্রীয় অর্থের আরেকটি 'মিউজিয়াম' হয়ে থাকবে—যেখানে সাজিয়ে রাখা থাকবে অদৃশ্য ব্যয়ের মূল্য তালিকা আর ধরা না পড়া দুর্নীতির দলিল।
আমরা চাই, দুর্নীতির এই গলাকাটা প্রকৌশলিক অভ্যাস ভাঙুক। দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনের সবচেয়ে কঠোর ধারায় বিচার হোক। যেন ভবিষ্যতের আমলারা ল্যাপটপের দামে লুটপাটের ল্যান্ডস্কেপ আঁকতে সাহস না পায়।
লেখক: এম এইচ মুন্না
প্রধান সম্পাদক, দৈনিক গণতদন্ত