স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেন এক নতুন শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রবেশে যে সহনশীলতা ও উন্মুক্ততা পূর্ববর্তী প্রধান প্রকৌশলীর সময়ে দেখা গিয়েছিল, তা যেন বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ মিয়ার দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই অতীতের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। এখন ‘নিরাপত্তা’ নামক একটি বর্মের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে দপ্তরের প্রতিটি কর্মকাণ্ড, যেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা পরিণত হয়েছে একটি পরিত্যক্ত নীতিতে।
বর্তমান বাস্তবতা এমন যে, এলজিইডির এই সদর দপ্তরে প্রবেশ করতে চাইলে সাংবাদিকদের পোহাতে হচ্ছে একাধিক স্তরের অনুমতি ও নিরাপত্তা যাচাই প্রক্রিয়া। কেবলমাত্র নির্দিষ্ট প্রকৌশলী বা কর্মকর্তার টেলিফোনে প্রত্যক্ষ সম্মতি পেলেই প্রবেশাধিকার মিলছে। এমন এক প্রশাসনিক অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে যা কার্যত সাংবাদিকদের স্বাধীন অনুসন্ধানী কার্যক্রমকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে।
তবে এই কঠোর ‘নিরাপত্তা’র আড়ালে চলছে এক অজানা রূপকথা। তথ্যসূত্র বলছে, বদলী, তদবির, ঠিকাদারদের সাথে গোপন আঁতাত—সবকিছুই অবাধে চলমান, একেবারে অন্তরালে। সাংবাদিকরা এ বিষয়গুলোতে অনুসন্ধান করতে গেলেই প্রাচীর উঠে যায় সামনে, বন্ধ হয়ে যায় দরজা, আর ঘুরতে হয় গার্ডদের ঠোঁটের উপর নির্ভর করে নির্মিত একটি প্রবেশ প্রক্রিয়ার গোলকধাঁধায়।
বাংলা ছায়াছবির সেই দর্শক হিসেবে সাদাকালো টিভিতে যেভাবে দেখা যেত "একা একা খেতে চাও দরজা বন্ধ করে খাও" বিজ্ঞাপন, এলজিইডির বর্তমান পরিস্থিতিও যেন ঠিক সেইরকম। ভিতরে কী হচ্ছে, কারা কীভাবে লাভবান হচ্ছে—তা জানতে পারার কোনো পথ নেই। অথচ এখানে তদবির বাণিজ্যের এক ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে সদ্য বিদায়ী এলজিআরডি এপিএস মোয়াজ্জেমের অঢেল সম্পত্তি অর্জনের মধ্য দিয়ে। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। আরেকদিকে অনেক কর্মকর্তা পারিবারিক বিপর্যয় বা গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে বদলির জন্য বারবার আবেদন জানিয়ে হাল ছেড়ে দেন। তাদের জুতো ক্ষয় হয়ে গেলেও ফল মেলে না। অথচ যাদের পেছনে থাকে ‘বড় তদবির’, তাদের বদলি হয় ফোনেই—তড়িত্ গতিতে।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, এলজিইডির বদলীর আদেশ ব্যবস্থা এখন এক রকমের অরাজকতায় পর্যবসিত হয়েছে। আদেশ আসে, বাস্তবায়ন হয়, আবার বাতিল হয়, আবারও নতুন করে পরিবর্তন হয়—এই চক্র যেন বিরতিহীন। সদ্যই সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ারকে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে বদলী করা হয়, পরে তাকে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় বদলী করা হয়। এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে যা অনুসন্ধান করলে একপ্রকার প্রশাসনিক নৈরাজ্যই সামনে আসে।
জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকার কথা ছিল অবিচ্ছেদ্য মৌলিক নীতি। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ এলজিইডি যেন রূপ নিয়েছে একটি 'সীমিত প্রবেশাধিকার সম্পন্ন নিরাপত্তা ঘেরা কুঠুরি'তে, যেখানে বাহিরের চোখ এড়িয়ে চলে এক প্রকার ‘প্রকৌশলিত গোপনীয়তা’।
এই অবস্থা যদি অব্যাহত থাকে, তবে শঙ্কা রয়েছে—এলজিইডি কেবল প্রশাসনিক নয়, নৈতিক দিক থেকেও এক চরম অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হবে। এখনই সময়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং সাংবাদিকদের স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের।
লেখক:
এম এইচ মুন্না
প্রধান সম্পাদক | দৈনিক গণতদন্ত